তারারা সম্পর্কে

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৫ সালের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের রাখালদার ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ করে মাথায় চড়ে বসে একটা সাহিত্য পত্রিকা করব। মাস্টার্স ডিগ্রির সার্টিফিকেট হাতে এসে গেছে—কাজ আসে নি। স্কুল বা কলেজে চাকুরি পাওয়ার মত প্রথাগত পরীক্ষায় বসেছি—উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসার মতো প্রতিদিনই একজন একজন করে সতীর্থ বন্ধুর সংখ্যা কমে আসছে। কারন তারা চাকুরিতে ঢুকে যাচ্ছে। একদিন দেখা গেল আমিই একমাত্র পুরোনো দলছুট বেকার বান্দা। একটা দুটো বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন পড়াই। হাতে মাসের শেষে সামান্য কিছু অর্থযোগ। হস্টেল ছেড়ে মেসে উঠেছি, সেই মেসের এক বন্ধু কাম ভাই বিন্দুবিকাশ কর্মকার দৈনিক স্টেটসম্যান বাংলা কাগজে কাজ পেয়ে সকাল দশটা টু রাত দশটা পত্রিকা অফিসে বহাল তবিয়তে কাজ করছে। সেই বিন্দুবিকাশের উদ্দীপনায় পত্রিকার নাম ঠিক হল—‘তারারা’। ‘তারারা’ মানে ‘তারার’ সমাহার। ‘তারারা’ হবে সেই সাহিত্য পত্রিকা যেখানে স্থান পাবে সেই সব আলোকসামান্য প্রতিভা প্রাণ। যাদের আলো সাহিত্যের অঙ্গনে পৌঁছায়নি, কিন্তু আলোকসম্ভাব্য একটু জায়গা পেলেই তাঁদের মননের আলোয় আলোকিত হতে পারে সাহিত্যের উঠোন।

দেখি না কী হয়—একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যক্তিগত প্রয়াসে প্রথম এ ফোর পৃষ্ঠায় ছাপা হল ‘তারারা’ পত্রিকা সাহিত্যের আলোকপত্র। কম্পোজের কাজ— বিন্দুর মানে বিন্দুবিকাশের। পত্রিকার লোগো বিন্দুবিকাশের। এরিনা মাল্টিমিডিয়া থেকে পাশ করা বিন্দুবিকাশ। আজ সে অনেক বড় পত্রিকা অফিসের উচ্চতর বিভাগে কর্মরত। প্রথম ‘তারারা’ টিউশন পড়ানোর বেতন থেকে। পরিকল্পনা হয়েছে, সাহস হয়নি—সত্যিকার অর্থে ‘তারারা’ আলোর মুখ দেখেছে পরিকল্পনার অনেক বছর পরে—সালটা সম্ভবত ১৯৯৮ হবে। মনে আছে এ ফোর পেপারে ‘তারারা’ ছাপিয়ে জেরক্স করে বন্ধুদের হাতে হাতে দিতাম, এবং বলতে দ্বিধা নেই একপাতা পত্রিকার রিভিউ বার হয়েছিল একপাতা— বাংলা দৈনিক স্টেটসম্যান কাগজে ! সেই যে ‘তারারা’ মননের আলো নিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল তা অব্যাহত ছিল সেইদিন পর্যন্ত যেদিন পাকাপাকিভাবে সরকারী চাকুরি পাইনি, তারপর নতুন কর্মক্ষেত্রের গতানুতিক প্রবাহে দুই তিন বছর বন্ধ হয়ে গেল। আবার চালু হল, এবারো বেশিদিন চলল না, কারণ ততদিনে কলকাতা কেন্দ্রিক পরিচিতি কমে এসেছে। পুরুলিয়ার মতো প্রত্যন্ত জেলায় এসে লেখা পাওয়াটা ভীষণ সমস্যার হয়ে গেল। আবারও ‘তারারা’ অমাবস্যার অন্ধকারে ডুব দিল। এরপর হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল ‘কবিতানগর’ পত্রিকার সম্পাদক দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কথায় কথায় ‘তারারা’র প্রসঙ্গ উঠতেই আবার বইমেলা ১৪২৮ থেকে ‘তারারা’ শুরু হল— যা আজ অব্দি বহমান। ইতিমধ্যেই ‘তারারা’ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। ক্রোড়পত্রের পাশাপাশি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পেরেছে।লেখক এবং কবির সংখ্যা বেড়েছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ‘তারারা’র আলোকদ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে। ‘তারারা’ পরিবার তৈরি হয়েছে। আসলে ‘তারারা’ খুঁজে বার করতে চায় সেইসব তারাদের যাঁদের আলো, মননদ্যুতি প্রতিভার আলো ছড়ায় নি কিন্তু ভেতরে গনগনে আলোর খনি প্রজ্জ্বলিত। একেবারে নতুন কবি সাহিত্যিক গল্পকার প্রাবন্ধিকদের প্রতিভা বিকিরণের প্রথম মাধ্যম, পরিক্ষার হাতেখড়ি প্লাটফর্ম হোক ‘তারারা’ পত্রিকা। নতুন কবি-লেখকদের ভয় কাটানোর প্রথম পরীক্ষাগার হবে ‘তারারা’—এই বাসনা নিয়ে ‘তারারা’র যাত্রা। তাই বলে প্রথিতযশাদের যে স্থান থাকবে না তা নয়, তাঁদের লেখাও জায়গা পাবে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে— শ্রদ্ধার সঙ্গে। ‘তারারা’ খুঁজে বার করতে চায় সেইসব কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের, যারা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এমনকি যারা বাঁকফেরা প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছিল—কিন্তু কোনভাবে তারা সময়ের চোখে অনেকটা সময় ধরে সম্পৃক্ত থাকতে পারেনি—সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলিকে পাঠকসমীপে তুলে আনার গোপন বাসনা পোষণ করে।

সৃষ্টির সাম্রাজ্যে বড়-ছোট বলে কিছু হয় না, সৃজনের লীলাখেলায় সবাই সমান, সবাই স্রষ্টা, সবাই ব্রহ্মা। তারারা সেই ব্রহ্মার অন্বেষণ করে। দেশ বিদেশের দ্রাঘিমা ঘুচিয়ে তারারা নিজের বৃত্তে অনড় দাঁড়াতে চায়। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ‘তারারা’ একজন স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি দিয়েই বিচার করতে চায়। লেখক নয়—লেখাটাই বিচার্য। আগামীদিনে ‘তারারা’ সাহিত্য সম্মান দিয়ে আগামী দিনের আলোকসামান্য প্রতিভাদ্যুতিকে সম্মানীত করতে চায়। সকলের আশির্বাদ ভালোবাসাময় ‘তারারা’ আলোক দিক, তারারার আলোকে আমরা আম-আদমি আলোকিত হই—এটুকুই বাসনা বৈ আর কিছু নেই এখন পর্যন্ত। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।

 

– সম্পাদক, তারারা